দ্বন্দ্ব কী। দ্বন্দ্বের কারণসমূহ।
দ্বন্দ্ব হলো একটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। অর্থাৎ এটি মানুষের মনের সাথে সম্পর্কিত। দ্বন্দ্ব মানুষের মনে তীব্য চাপ ও পীড়ন সৃষ্টি করে। মানুষের চাওয়া - পাওয়ার অপূর্ণতা থেকে এরূপ অবস্থার সৃষ্টির হয় । যেমন প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মীগণ ব্যবস্থাপনার নিকট যতটা প্রত্যাশা করে ঠিক ততটা তারা পায় না । আবার শ্রমিকদের নিকট থেকে ব্যবস্থাপনার প্রত্যাশা পূরণ হয় না । মূলত এরূপ অবস্থা থেকে শ্রম - ব্যবস্থাপনার মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় ।
দ্বন্দ্বের সংজ্ঞা :
সাধারণত দ্বন্দ্ব বলতে একাধিক বস্তু বা বিষয়ের প্রতি ব্যক্তির পরস্পর বিরোধী প্রবণতাকে বুঝানো হয় । কিন্তু শিল্পাঙ্গনে শ্রম - ব্যবস্থাপনার মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থ সংশিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে যে অসম্মতি বা মতদ্বৈততার সৃষ্টি হয় তাকে দ্বন্দ্ব বলে । নিম্নে দ্বন্দ্বের কতিপয় উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করা হলো :
Weihrich & Koontz এর মতে
দ্বন্দ্ব হলো সাংগঠনিক জীবনের একটি অংশ এবং এটি ব্যক্তির মধ্যে , ব্যক্তিবর্গের মধ্যে , ব্যক্তি এবং দলের মধ্যে এবং দলগুলোর মধ্যে সংঘটিত হতে পারে।
Mery Keith Davis এর মতে
দ্বন্দ্ব হচ্ছে এরূপ এক অবস্থা যাতে দুই বা ততোধিক পক্ষ তাদেরকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে । দ্বন্দ্ব হচ্ছে একটি আন্তঃব্যক্তিক প্রক্রিয়া যা লক্ষ্য অর্জনের উপর অসম্মতি থেকে আসে অথবা ঐ লক্ষ্য সম্পাদনের ব্যবহৃত পদ্ধতি থেকে উদ্ভব হয় ।
দ্বন্দ্ব একটি জটিল বিষয় । দ্বন্দ্ব বিভিন্ন কারণে সৃষ্টি হতে পারে । কেউ কেউ মনে করেন , এক ব্যক্তির সাথে অন্য ব্যক্তির ধ্যান - ধারণা , মতামত ও অনুভূতি তথা যোগাযোগের পার্থক্যের কারণে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় । তাই একক কোন কারণে এটি সৃষ্টি হতে পারে না । সাধারণত আন্তঃব্যক্তিক এবং আন্তঃদলীয় সম্পর্ক থেকে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় । নিয়ে দ্বন্দ্বের প্রধান প্রধান কারণগুলো উল্লেখ করা হলো :
১. মূল্যবোধের পার্থক্য :
ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে মূল্যবোধ , নীতি ও উদ্দেশ্য এবং আচরণের পার্থক্যের কারণে দ্বন্দ্বের উদ্ভব হতে পারে । নিজস্ব বিশ্বাস ও আদর্শের প্রতিফলনজনিত কারণে একে অন্যের মধ্যে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয় । প্রতিষ্ঠানের প্রচার , মজুদের ধরন , বিকল্প পণ্য ইত্যাদি বিষয়ে মতানৈক্যর কারণে বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে দ্বন্দ্বের উদ্ভব ঘটায় ।
২. আস্থার অভাব :
একে অন্যের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের অনুভূতি পারস্পরিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে । প্রত্যেকে প্রত্যেকের কথা ও কাজের মধ্যে মিল না রাখলে এরূপ দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। পারস্পরিক অবিশ্বাস ও আস্থার অভাবে সম্ভাব্য দ্বন্দ্বের উদ্ভব ঘটায়।
৩. ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব :
প্রতিটি ব্যক্তির চিন্তাচেতনা , অনুভূতি - ভাবনা এবং আচার - আচরণ ভিন্ন প্রকৃতির হয়ে থাকে। ব্যক্তির এরূপ বিভিন্নতার কারণে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় ।
৪. অনুভবের বৈপরীত্য :
পূর্ব অভিজ্ঞতা ও প্রত্যাশার কারণে , কোন বিষয়ে ব্যক্তির অনুভূতি ভিন্নতর হতে পারে । কোন বিষয়ে একজন যা অনুভব করে অন্যজন সেভাবে তা নাও করতে পারে । কিন্তু ব্যক্তি যদি তার নিজস্ব অনুভব শক্তি অনুযায়ী অন্যকেও সমঅনুভব শক্তির অধিকারী দেখতে চায় তাহলেই দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় ।
৫. সুষ্ঠু যোগাযোগের অভাব :
কার্যকর যোগাযোগ প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। যোগাযোগের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তি , বিভাগ ও শাখার উদ্দেশ্য অর্জনের সমন্বয় বিধান করা হয়। তাই সুষ্ঠু যোগাযোগে ব্যাঘাত ঘটলে শ্রমিক ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে সংযোগ বিনষ্ট হয় । নানা বিষয়ে বিকৃতি ও গুজবের সৃষ্টি করে। ফলে কার্যক্ষেত্রে পারস্পরিক দ্বন্দ্বের জন্ম দেয় ।
৬. পারস্পরিক নির্ভরশীলতা :
সীমিত সম্পদের কারণে সংগঠনের বিভিন্ন বিভাগ , শাখা বা দল পরস্পর নির্ভরশীল থাকে । আন্তঃনির্ভরশীলতা এরূপ মাত্রা অধিক হলে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হতে পারে । প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদের তুলনায় অন্যান্য সম্পদের সীমাবদ্ধতা একে অন্যের মধ্যে দ্বন্দ্বের উদ্ভব ঘটায় ।
৭. লক্ষ্যের ভিন্নতা :
প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মীদের লক্ষ্যের সাথে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যের সামঞ্জস্য না থাকলে কার্যক্ষেত্রে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হতে পারে । যেমন- ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের প্রধান লক্ষ্য হলো মুনাফা সর্বাধিক করা । এক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি জন্য সচেষ্ট হয় । কিন্তু কর্মীগণ যদি তাদের উপরে অর্পিত দায়িত্ব পালনের মনোযোগী না হয় সেক্ষেত্রে শ্রম ব্যবস্থাপনার মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হতে পারে । একইভাবে প্রতিষ্ঠানের । উন্নতির সাথে সাথে কর্মীর উন্নতি না ঘটলেও দ্বন্দ্বের উদ্ভব হয় ।
৮. ব্যক্তি দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য :
দ্বন্দ্বের একটি অন্যতম কারণ হলো এক ব্যক্তি দৃষ্টিভঙ্গির সাথে অন্য ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য । এরূপ পার্থক্যের কারণে পরস্পরের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় বজায় রাখা সম্ভব হয় । না । যেমন- কার্যক্ষেত্রে এমন কতিপয় ব্যক্তি আছে , যারা সহযোগিতা , সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে চায় । আবার অনেক কর্মী আছে যারা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে অভ্যস্ত । ফলে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় ।
৯. সাংগঠনিক কাঠামোর ভিন্নতা :
সাংগঠনিক কাঠামো সুস্পষ্ট না হলে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হতে পারে । অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের নিয়োজিত কর্মীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য যদি সুনির্দিষ্ট না হয় তা হলে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপকতা ও পরিমাণ সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা থাকে না । এতে কোন কর্মী অত্যধিক কার্যভারে আক্রান্ত হতে হয় । পক্ষান্তরে , অন্যদের উপর কাজের চাপ কম থাকে । ফলে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় ।
১০. শিক্ষাগত যোগ্যতা :
প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত সকল কর্মীর শিক্ষাগত যোগ্যতা একই রকমের থাকে না । সাধারণত প্রতিষ্ঠানের নির্বাহিগণ উচ্চ ডিগ্রিধারী হয়ে থাকে । পক্ষান্তরে , সাধারণ শ্রমিকরা অশিক্ষিত বা কম শিক্ষিত হয়ে থাকে । এমতাবস্থায় তাদের মধ্যে চিন্তাভাবনা , ধ্যান-ধারণা , জ্ঞান ও দক্ষতার মধ্যে পার্থক্য দেখা দেয় । ফলে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।
বিভিন্ন কারণে একটি প্রতিষ্ঠানে বা সংঘটনের দ্বন্দ্বের উপস্থিতি ঘটে থাকে । দ্বন্দ্বের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে ব্যবস্থাপনাকে দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় ।
Comments
Post a Comment